লাইফ টার্ন

লাইফ টার্ন
আব্দুল্লাহ মামুন অক্ষ 
--------------------------------------------------------------------
বিমানবন্দর থেকে বিমান ছেড়েছে ঘন্টা তিনেক হলো। বুঝবার উপায় নেই কোন দেশে আছি এখন।
জানালার ওপাশে শুধু শুভ্র মেঘের উড়াউড়ি,পেজো তুলোর মত নরম মেঘ।
মেঘের বিশাল পাহাড় কেটে কেটে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বিমান।
কেনো জানি প্রকৃতির এই বিষয়গুলো মনে আর দাগ কাটতে পারে না।
কি জানি কেনো! হয়তো এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি কিংবা বুড়িয়ে যাচ্ছি!
বয়স তো আর কম হলো না... আমার পাশের ভদ্রলোকটি বেশ।
বিমানবন্দরেই প্রথম পরিচয় হলো।প্রথম পরিচয়েই আলাপ বেশ জমে গেছে।
এমনকি ঘরকন্নার ব্যাপারগুলোও।ঘরে তার সুন্দরী স্ত্রী। সেই মহিয়সীর জন্য মাঝে মাঝেই তিনি বেশ উতলা হয়ে যাচ্ছেন।
অনেকটা প্রথম প্রেমে পড়লে যে রকম হয়! তবে লোকটার ব্যবহার অমায়িক।
মানুষকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা তার চোখে মুখে।আমার পরিচয় পেয়েই তিনি বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন হঠাৎ।
-আরে ধ্রুব সাহেব! আপনার লেখা পড়েছি।বেশ লেখেন আপনি!
-এ আর এমন কী! লেখালেখি আমাররটেশা নয়,বলতে পারেন নেশা।
আর জীবনকে অনেক কাছের থেকে দেখেছি তো, তাই জীবনের অলি-গলি মোটামুটি চেনা।
সেই কথাগুলিই উগড়ে দেওয়া আর কি!
-সে আপনি যাই বলেন! মাইরি বলছি,আপনার লেখায় জীবন খুঁজে পাওয়া যায়।আমার স্ত্রীও আপনার লেখার ভক্ত।
মাঝে মাঝে আপনার লেখা পড়ে ওকে কাঁদতে দেখেছি।
চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ত।
যাহোক, সুইজারল্যান্ডে কি করছেন আপনি?
-সুইজারল্যান্ডে একটি কোম্পানিতে মেকানিকাল ইজ্ঞিনিয়ার হিসেবে কাজ করছি। 
আর এই দু'এক লাইন লিখি।এই আর কী!
এয়ার হোস্টেস এসে কফি আর লাইট ফুড দিয়ে গেলো। দেখতে বেশ মেয়েগুলি!
Smart বলতে যা বুঝায়।সবসময় মুখে হাসি আর কেমন যেনো একটা বিনীত ভাব।
ঝক্কিঝামেলা ও কি কম পোহাতে হয় এদেরকে!
সবাই কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে,বিশেষ করে কোমর বুকের খালি অংশের দিকে।
আবার কেউবা পেরেও না পারার ভান করে বলে,
"Excuse me,would please help me to bind my
seat belt?"
ওদের শরীরে স্পর্শ লাগানোর ফন্দি একটা! ওরা আর কি করবে!
"sure sure,why not?"বলা ছাড়া আর কি করবে।যাদ্রীদের জন্য ওরা নিবেদিত প্রাণ!
অধরার ও এয়ার হোস্টেস হওয়ার খুব ইচ্ছা ছিল।ও প্রায়ই বলতো,"দেখো আমি ঠিকই এয়ার হোস্টেস হবো!"
ওকে খোঁচা দিয়ে বলতাম,"হু,মহারাণী এয়ার হোস্টেস হবেন!এয়ার হোস্টেস হতে হলে চেহারায় কিছু থাকা লাগে বুঝলেন!
তোমাকে দেখতে যা লাগে না!
তাতে..."
মূহুর্তের মধ্যে দপ করে নিভে যেতো ও।অনেকক্ষণ রাগ করে থাকত।তারপর বলতো,"তুমি চাওনা আমি এয়ারহোস্টেস হই।
তো এত ঢং করার দরকার কি,হ্যাঁ??"
-
তুমি তো জানো,তোমাকে ছাড়া আমি দূরে থাকতে পারবো না,তবু কেনো...
-আচ্ছা বাবা,ঠিক আছে।মন খারাপ করছো কেনো?সারাজীবন আমি তোমার লেজ ধরেই ঘুরে বেড়াবো! খুশি???
বলেই ওর সেই ভুবনভোলানো হাসি,যা আমি কোনদিনও হয়তো ভুলতে পারবো না,পারিনি।
ওর স্মৃতি আমাকে এটি ভুলতে দিবে না। কি জানি কোথায় আছে ও!কতদিন দেখি না ওকে।
শেষবারের মত ওকে দেখেছিলাম কোনো এক ভ্যালেন্টাইন ডে-তে।
কার্জন হলের সামনে সেদিন অনেকক্ষণ অপেক্ষা কররেছিলো ও।
টিউশনি করে আসতে আসতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। 
পেছন থেকে এসে ওর চোখটা ধরে চমকে দিয়েছিলাম। একটা নীল শাড়ি পড়েছিল ও।
আগের দিন নিউমার্কেট থেকে সারা বিকেলটা ঘুরে টিউশনির পুরো টাকা দিয়ে এটা কিনেছিলাম।
নীল শাড়িতে অন্যরকম লাগছিলো ওকে। তারপর রিকশায় করে অনেকক্ষণ ঘুরেছিলাম।তারপর বলাকাতে।
তাও প্রায় বিশ বছর হতে চললো। বিশটি বছর!!
হঠাৎ করেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো।বিমানের জানালার ওপারে পৃথিবীতে আঁধার নেমেছে ততক্ষণে।
জ্যোৎস্নার আলো ফুটছে কেবল। রুহুল সাহেবের চোখে-মুখে ঘুম লেগে আছে।ঝিমুচ্ছেন তিনি।
মায়াময় একটি ঘোরলাগা পরিবেশ চারিদিকে। কেনো জানি অধরাকে মনে পড়ছে খুব।
স্বপ্নের মত ছিলো দিনগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকতো ও,আর আমি আহসানউল্লাহ হলে।
কোনোদিন টি.এস.সি তে জম্পেশ আড্ডা,কোনদিন বা ধানমন্ডি লেক।
আবার কখনো উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়ানো।রিকশায় আবার কখনো শহর চষে বেড়ানো।
কোনো সন্ধ্যায় আবার বলাকায় সিনেমা দেখা। রাত করে হলে ফিরা। 
ছোটোখাটো রোমাঞ্চ, হাতে হাত,লজ্জ্বায় ছোট্ট করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেওয়া, তারপর ওর নাকমুখ লাল হয়ে যাওয়া!
এভাবেই চলছিলো দিনগুলি। হঠাৎ করেই বাবা মারা গেলেন। কেমন যেনো অন্যরকম হয়ে গেলাম। 
নিজেকে নিজের সাথে মেলাতে পারতাম না। মায়ের অনুপ্রেরণা,বাবার স্বপন,ছোটো বোনদের নিষ্পাপ মুখ আমাকে ভেঙে পড়তে দেয় নি।
আর একজনের ভালোবাসা নীরবে কাজ করে যেতো!মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভাবে ভেঙে পড়তাম।
নীরবে কান্না করতাম,কিন্তু এটাও চোখ এড়াতো না ওর। 
মায়ের কষ্টেভরা অথচ প্রত্যয়ী মুখ,বাবার বুনে দেওয়া স্বপ্নবীজ আর ওর স্নেহমাখা ভালোবাসার কারণেই হারিয়ে যাওয়া নিজেকে ফিরে পেতাম।
স্বপ্ন দেখতাম নততুন করে বাঁচার,বাঁচানোর। স্কলারশীপ নিয়ে সুইজারল্যান্ড গেলাম।
তারপর থেকে কেনো জানি অধরার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হতে লাগলো।ও কেননো জানি অন্যরকম হতে লাগলো।
ঠিক আগের মতো ওকে মিলাতে পারতাম না। তারপর পৃথক হয়ে গেলাম দু'জনে। ৪ বছরের প্রেমে চির ধরলো।
এর দায় আমি ওকে দিইনা কখনো,আবার নিজেকেও অপরাধীর কাঠগরায় দাঁড় করাতে পারি না।
প্রথম প্রথম যোগাযোগ হতো।তারপর আর হয়ে উঠে নি।একবার শুনেছিলাম বিয়ে হয়েছে ওর কোন এক
বিজনেসম্যানের সাথে পারিবারিক ভাবে।সম্ভবত সবুজ বলেছিল।খবরটা যে খুব ভালো লেগেছিল তা নয়।
বরং খুব হতাশ হয়ে যেতাম,একাকীত্ব চারিদিক হতে গিলে ফেলতে চাইত আমাকে।
ও অন্য কারো জীবন সঙ্গিনী এটা ভাবতেই এখনো বুকের বামপাশে চিনচিন করে ব্যথা করে।
-ধ্রুব সাহহেব,এয়ারপোর্টে কে আসছে নিতে? ভাবি নিশ্চয়ই!
ভাবনায় ছেদ পড়ল রুহুল সাহেবের কন্ঠ শুনে।সেই সাথে প্রশ্নটার জন্য সাময়িক একটা শূন্যতাও অনুভব করলাম।
থতমত করে হেসে দিয়ে বললাম,"ভাবী! ভাবী আসবে কোত্থেকে!?"
-কেনো বিয়ে করেননি নাকি? -নাহ তা আর হলো কোথায়!
রুহুল সাহেব আশ্চর্য হয়ে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।
মনে মনে ভাবছিলেন, 'এ আধা চুল পাকা বুড়ো বলে কি!' তার জিগ্যাসু চোখে অনেক প্রশ্ন বুঝতে পারছি।
আমার হাসি দেখে তিনি বুঝে নিলেন মনে হয়,আর প্রশ্ন করলেন না।আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
কারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে আমার সবচেয়ে বড় এলার্জি।আর অধরা এই কাজটা করতো সবচেয়ে বেশি।
ম্যাজিস্ট্রেটের মত,'কেন চুল এতো ছোট করেছি, কেন শুকনো শুকনো লাগছে তোমায়! কত্ত প্রশ্ন!!
রুহুল সাহেব বললেন, "যদি কিছু মনে না করেন রাতে আমার বাসাতেই থাকেন,ও অনেক খুশি হবে।
আপনার রেখা ও দারুণ পছন্দ করে।"
-আচ্ছা সে দেখা যাবে। বিমান বাংলাদেশের ভূ-খন্ডে পৌঁছেছে অনেক্ষণ।একটু পরেই হয়তো ল্যান্ড করবে এয়ারপোর্টে।
মাটি থেকে বিমানের দূরত্ব কমছে। আর আলোকময় ঢাকাকে অন্যরকম লাগছিল।শতশত তারা জ্বলছে যেননিচে।
আর চারিদিক কেমন মায়াময়,স্তব্ধ। বিমান আস্তে আস্তে নিচে নামছে।
জ্যোৎস্নার আলোয় রানওয়েতে বিমানের ছায়ার দৈর্ঘ্য বাড়ছে।তারপর তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে এটি রানওয়ে স্পর্শ করলো।
মূহুর্তেই শিহরণ খেলে গেল শরীরে,কেঁপে কেঁপে উঠছে গা।কত বছর পর ফিরে আসা আমার জন্মভূমিতে।
উত্তেজনায় দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।রানওয়েতে অনেক্ষণ দৌঁড়িয়ে বিমান থামল।বিমান থেকে নামলাম।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম অনেক্ষণ। বাতাসে আমার জন্মভূমির মাটির সোদা গন্ধ!
রিসেপশনে এলাম।রুহুল সাহেবের স্ত্রী এসেছেন নাকি গাড়ি নিয়ে। আর তার ছেলে।
রুহুল সাহেব কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন । সামনের দিকে।চার-পাঁচ বছরের একটা ছেলেতাকে' বাবা বাবা' বলে উঠল।
রুহুল সাহেব ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে নিলেন। বাবা-ছেলের মিলন। দেখতে বেশ ভালোই লাগছিলো। পাশেই তার স্ত্রী।
নীল শাড়ি পরেছেন তিনি।কিন্তু চেহারাটা যেন কেমন চেনা চেনা লাগছে।রুহুল সাহেববকে জিগ্যাসা করলেন,"কেমন
ছিলে,পথে কোন সমসা হয়নি তো?"
চমকে উঠলাম।খুব পরিচিত একটা কন্ঠ। এবার আর চিনতে ভুল হলো না।
ভালো করে তার দিতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠি,'অধরা!'
নিজেকে জোর করে সামলালাম। ভাগ্য আবার আমাকে নিয়ে খেলছে।
রুহুল সাহেব তার স্ত্রীরর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন,"আমার স্ত্রী অধরা শিকদার,আর অধরা দেখো তো ইনাকে চিনো কি না?" অধরার মাথা নিচু।
ও আমার দিকে তাকাতে পারছে না।
আরে ইনি ধ্রুব সাহেব,তোমার প্রিয় লেখক।ধরে এনেছি।এখন তুমিই জানো এটাকে কি করবে!"
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ও আমার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যতার হাসি দিলো।
ঠিক বিশ বছর আগের সেই হাসি,বুঝলাম হাসতে ওররপ্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। অভাগা আমি তাও পারলাম না।
ও কখনো এটা আশা করেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় ও স্তব্ধ।রুহুল সাহেবরে বললাম,"আমার গাড়ি আসছে, বিদায় তাহলে"
-সে কি গাড়ি আসছে মানে?
না ভাই,তা হবে না।আপনি আজ রাতে থাকবেন আমার বাসায়।
-সে কি করে হয়!আমি হোটেলে রুম বুক করেছি যে!যাই ভাই।
হয়তো দেখা হবে জীবনের কোন এক জংশনে!
রুহুল সাহেবের ছেলেকে আদর করে কোনোমতো ওর সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলাম।
গাড়ি এসেছিল।লাগেজগুলো পিছনে উঠানোর পর গাড়িতে উঠে বসলাম।
রবীন্দ্র সংগীত বাজছিল টেপরেকর্ডারে।কেন জানি কান্না পাচ্ছিল। কত পরিবর্তন হয়ে গেছে ওর।
চেহারায় ব্যক্তিত্ব আর বয়সের দৃঢ় ছাপ।সেই নীল শাড়ির অধরা নীল শাড়িতেই কত ভিন্ন!
সময় কত বদলে দেয় মানুষকে। আমি জানি ও এখন কাঁদছে।নীল শাড়ির আঁচল দিয়ে কান্না লুকানোর প্রানপণ চেষ্টা করছে।
ভুলে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে বিশ বছর পরে দেখা আমাকে। পারবে কি ও?

ধ্রুব অক্ষ

No comments:

Post a Comment

HINDI PROPOSE SHAYARI SMS

HINDI PROPOSE  SHAYARI   Dil ye mera Tumse Pyar karna chahta hai, Apni Mohabbat ka izhaar karna chahta hai, Dekha hai jab se Tumhe aey me...